শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

কলরেটে করের ফাঁদ

*সম্পূরক শুল্ক বসানো টেলিকম নীতিমালা ২০১৮-র পরিপন্থি
*২০১৮ সালের কলরেটসংক্রান্ত হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত
*বৃদ্ধি হওয়া শুল্ক প্রত্যাহার না হলে আন্দোলনের হুমকি
*রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটকের উন্নয়নেও বরাদ্দ নেই বাজেটে

১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া উপগ্রহ কেন্দ্র চালুর মাধ্যমেই বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগের যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন সময় থেকেই এ সেবা ছিল উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের যোগাযোগ বিলাসিতার মাধ্যম। এরপর ’৯০-র দশকে ১-জি ও ২-জি সেবার মাধ্যমে তারবিহীন মুঠোফোন সেবা চালু হলেও এ ব্যবসাকে মনোপলি ও লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে নেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯৭ সাল থেকেই এ খাতে মনোপলি ভাঙলে তৃণমূলের সামর্থ্যের নাগালে চলে আসে এ সেবা। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমানে দেশে ৫-জি চালুর প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। একদিকে বর্তমান সরকার যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ব্যয়ও বৃদ্ধি করতে চায়। এ নিয়ে সরকারের দ্বিমুখী নীতি আজ দেশবাসীর কাছে প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।

গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি বাজেটে টেলিযোগাযোগ সেবা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। হয়তো সেটা কথা বলায়, না হয় ইন্টারনেট ব্যবহার করায় কিংবা হোক সেটা ডিভাইস ক্রয়ে। বর্তমানে দেশের সকল সেবা সংস্থাসমূহের চেয়ে রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে অগ্রগামী টেলিযোগাযোগ খাত। জিডিপির প্রায় ৬.৫ শতাংশ এ খাত থেকেই আসে।

বিটিআরসি রাজস্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে এ খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় ছাড়াও লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও তরঙ্গ বিক্রি বাবদও হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় করে নিচ্ছে। বর্তমানে এ খাতে গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি ৬৫ লাখ।

এ খাত থেকেই অদৃশ্য অর্থ আদায় করা যায় বলে সবচে বেশি চাপ প্রয়োগ করে রাজস্ব আদায় করা হয় এ খাতে— এমনটাই মনে করছেন অনেকে। ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ আদায় করার ফলে গ্রাহকরা যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে সমস্যায় পতিত হয় না সেহেতু এ খাত রাজস্ব আদায়ের উত্তম মাধ্যম বলেও সরকারের কাছে বিবেচিত। সরকারের প্রতি এ ধরনের চিটিংবাজি বন্ধের আহ্বান জানান গ্রাহকরা।

গত ১৩ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করেন। বাজেটে টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন করে করারোপ করা হয়; যা ১৫ কোটি ৬৫ লাখ গ্রাহকের মনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

অর্থমন্ত্রী হয়তোবা অবগত নন যে, গত বছর বাজেটে কলরেট বৃদ্ধির পর পুনরায় নতুন করে ১৫ আগস্ট ২০১৮ তারিখে ২৫ পয়সা সর্বনিম্ম কলরেটের স্থলে ৪৫ পয়সা সর্বনিম্ম কলরেট নির্ধারণ করলে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনসহ বেশকটি সংগঠন আন্দোলন শুরু করে।

তৎকালীন সময়ে আন্দোলনের ফলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন গত বছর ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে কলরেট বৃদ্ধিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এমতাবস্থায় হাইকোর্টের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নতুন করে করারোপ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন ছিল সরকারের— এমনটাই মনে করছেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মেদ।

যদিও প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস অ্যাক্ট ১৯৩১-এর ধারা ৩ অনুযায়ী আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করসংক্রান্ত আংশিক পরিবর্তন বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়।

কিন্তু হাইকোর্টের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে গ্রাহক সমাজের ওপর আরোপিত কর দিতে বাধ্য নয় বলেও দাবি করেন মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, আমরা হাইকোর্টের পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকবো। যদি গ্রাহকদের কাছ থেকে কোনো প্রকার অর্থ আদায় করা হয় তার জন্য অপারেটর ও সরকারই দায়ী থাকবে।

এদিকে চক্রবৃদ্ধি হারে যে করারোপ করা হচ্ছে তাতে গ্রাহকরা শতকরা প্রায় ৫৬ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে দিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে আদায় হবে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জুন ২০১৫ পর্যন্তও মোবাইল ফোন ব্যবহারে শুধু ১৫ শতাংশ ভ্যাটই দিতেন গ্রাহক।

২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিলেও পরে তা ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় বিভিন্ন পক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে। কিন্তু দুই বছর বাদেই আবার এ শুল্ক ৫ শতাংশ করে দেওয়া হয়, যেটি এবার ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হলো। এরমাঝে যোগ করা হয়েছে ১ শতাংশ সারচার্জ।

নতুন সম্পূরক শুল্ক আসার কারণে এখন মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর মোট ট্যাক্স গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশে। ফলে কেউ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কোনো একটি সেবা নিতে যদি ১০০ টাকা রিচার্জ করেন তাহলে তিনি ৭৮ দশমিক ২৭ টাকার সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। আর বাকি ২২ দশমিক ৭২ টাকাই চলে যাবে সরকারের কোষাগারে।

বাংলাদেশের মানুষ এখন একেকটি সংযোগে মাসে গড়ে ১৫০ টাকা খরচ করে। নতুন ট্যাক্সের কারণে তার খরচের হিসেব আরও ১৫ থেকে ২০ টাকা যোগ হবে। আর গত পাঁচ বছর ক্রমান্বয়ে খরচ বাড়ার হিসাব ধরলে টাকার অংকে তা কয়েক হাজারে চলে আসে। সিম কার্ডের ওপর নতুন করে ১০০ টাকার স্থলে ২০০ টাকা ভ্যাট নির্ধারণ নতুন গ্রাহকদের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। এতে করে অতিরিক্ত আদায় হবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।

তাছাড়া অপারেটরদের উৎস আয়ের ওপর নতুন করে ১.২৫ শতাংশ করের বোঝাও গ্রাহকদের ওপর চাপবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশেন। এরমধ্যে ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে মোবাইল ফোন আমদানির ওপর ভ্যাট একধাপে ১৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়, যদিও সে সময়ই স্থানীয় সংযোজনের ওপর দেওয়া হয় কিছু সুবিধা।

আর পরের বছর হ্যান্ডসেট আমদানিতে বাড়িয়ে দেওয়া হয় সম্পূরক শুল্কও। ফলে যেটি হলো— একেকটি স্মার্টফোনের ওপর গড় খরচ বাড়লো এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। দেশে প্রযুক্তিবিদ ও স্মাটফোন তৈরির দক্ষ জনবল তৈরি না করে বিদেশিদের উৎপাদনে সুবিধা দিলে শুধু উৎপাদনকারীই লাভবান হবে বলে দাবি করে সংগঠনটির নেতারা।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে গত অর্থবছরের চেয়ে বরাদ্দ বেড়েছে ৬২১ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল। যা গত অর্থবছর থেকে ৬২১ কোটি টাকা বেশি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সংশোধিত বাজেটে দুই হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা পেয়েছিল। আর সে অর্থবছরে বিভাগটিতে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগসহ অন্য মন্ত্রণালয় মিলে সামগ্রিকভাবে এ বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বরাদ্দ প্রায় ২২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১১ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বরাদ্দ বাড়ছে ১৯৩ কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে মোট ৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বরাদ্দ বাড়ছে ৬২১ কোটি টাকা। বিভাগটির উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ২ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয় মিলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৫ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়— গত বছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট রয়েছে এমন দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এ অর্জন বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

এছাড়া দেশের সব ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় পাঁচ হাজার ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ২৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপন করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটি ছাড়িয়েছে।

সারা দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক হচ্ছে। অথচ সার্বিকভাবে বাজেট বৃদ্ধি পেলেও জনসাধারণকে সুকৌশলে করের ফাঁদে আটকানো হয়েছে। কলরেট বৃদ্ধি, ইন্টারনেটের মূল্যবৃদ্ধি ও ডিভাইসের মূল্যবৃদ্ধি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণকে বাঁধাগ্রস্ত করবে বলেও মনে করেন মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন। এমনকি এতো বরাদ্দের মাঝেও একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটকের উন্নয়নে কোনো বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়নি।

গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন নেতারা জানান, সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয় কোনো পণ্য বা সেবাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য। অথচ এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আজকে দেশে পাঠাও, উবারসহ ইন্টারনেট ব্যবসায় হাজারো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

দুঃখের বিষয়- বর্তমান সরকার প্রযুক্তির প্রসার করার কথা বললেও এ খাতে সম্পূরক শুল্ক বসিয়ে টেলিকম নীতিমালা ২০১৮ পরিপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের প্রতি জনগণের ওপর এই অন্যায় করের বোঝা প্রত্যাহারের আহ্বানও জানান তারা।

আরও উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রমুখ। তারা বলেন, সরকার যদি এই শুল্ক প্রত্যাহার করে না নেন তাহলে আমরা আবারো জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামবো।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877